পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ যেভাবে ধীরে ধীরে কমে আসছে ঠিক তেমন ভাবেই কমে আসছে পশু- পাখির সংখ্যা। আকাশ আমাদের নাগালের বাইরে ! সেই আকাশকে ছুঁয়ে দেখবার দুর্নিবার আকাঙ্খা আমাদের সবার মনে। চিরকালই এই পাখীর প্রতি মানুষের দুর্নিবার আকর্ষণ । অনায়াসে সেই আকাশের বুকে বিচরণ করে বেড়ায় এই পাখীরা।পৃথিবীতে অনেক ধরণের পাখী দেখতে পাওয়া যায়। এই বিভিন্নতার মধ্যেও প্রত্যেকের দৈহিক গঠন, আচার ব্যবহার ও আওয়াজ লক্ষ্য করে তাদের চিনতে শিখি।
মানুষ সারি সারি গাছ লাগাতে পারে ঠিকই ,কিন্তু অরণ্য সৃষ্টি করতে পারে না। অতএব সর্বশক্তিমান মানব সবকিছু পারলেও অনেক কিছু এখনো করে উঠতে পারে না।
এই না-পারা গুলো থেকেই পাখির প্রতি মানুষকে কৌতূহলী করে তুলেছে। এই কৌতূহল এবং পাখির প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও তাকে জানার আগ্রহ থেকেই আজকের বিষয়, হর্নবিল বা ধনেশ পাখি। আমাদের রোজকার দেখতে পাওয়া চড়াই,শালিক,কাক থেকে একটু অন্যধরণের পাখি, হর্নবিল।

পৃথিবীতে হাজারো রকমের পাখী আছে। যেমনি তাদের রঙের বাহার, তেমনি তাদের নানা রকম গড়ন। সব পাখীর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য,এদের কারোই দাঁত নেই। এদের খাদ্যের ধরণ অনুযায়ী ঠোঁটের আকৃতি ও আয়তন আলাদা হয়ে থাকে। এমনি এক বিশেষ আকারের ঠোঁট যুক্ত পাখি ‘ধনেশ বা হর্ন বিল’। আমাদের দেশে মোটামুটি নয় রকমের হর্নবিল দেখতে পাওয়া যায়।

1) Great Indian Hornbill
2) Rufous Necked Hornbill
3) Wreathed Hornbill
4) Austen’s Brown Hornbill
5) Narcondam Hornbill
6) Malabar Pied Hornbill
7) Oriental Pied Hornbill
8) Malabar Grey Hornbill
9) Indian Grey Hornbill

আকার ও দেহের গড়ন –

বিভিন্ন অঞ্চলের জলবায়ু ও পরিবেশ হিসেবে হর্নবিলের ঠোঁটের আকার ,গায়ের রং ,দেহের গড়ন ও শরীরের ওজন আলাদা আলাদা হয়। ইন্ডিয়ান গ্রে হর্নবিল এবং ইন্ডিয়ান পাইড হর্নবিলের মাথায় মুকুটের মতো শিরস্ত্রাণ থাকায় এদের দেখতে বাকিদের থেকে একটু আলাদা।
কোনো কোনো হর্নবিলের গলার নিচে পাউচের মতো বা পুটুলির মতো থাকে তাদের “প্লেইন পাউচ হর্নবিলও” বলা হয়।
এই বড়ো মাপের পাখী গুলি জঙ্গলে থাকতে বিশেষ ভালোবাসে। অরণ্যের সৃষ্টিতে পাখীর অবদানের কথা আমরা সবাই কম বেশি পরিমানে জানি । অরণ্য সৃষ্টিতে ধনেশ পাখির অবদান বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য। ধনেশ পাখিকে ‘বনচাষি’ বা ‘ফরেস্ট ফার্মার’ ও বলা হয়ে থাকে।

এদের সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ঠোঁট,দেখে মনে হবে,কত না ভারী,ওদের কত কষ্ট। আসলে খুবই হালকা। এদের ঠোঁটের ভিতরের গঠন এমনই,যখন এরা ডাকে, তখন বীভৎস ভয় জাগানো আওয়াজ তৈরী হয়। এদের ঠোঁট দেখে যে কেউ সহজেই এদের চিনতে পারবে। এদের ঠোঁট শক্ত, হাড় জাতীয় পদার্থ দিয়ে তৈরী। এই ঠোঁটের সাহায্যেই এরা ফল থেকে শুরু করে কীট পতঙ্গ,ছোটোখাটো প্রাণী শিকার করে।

বিশেষ বৈশিষ্ট্য,এদের ঠোঁটের উপরে থাকা বড় খাঁজের মতো উঁচু হয়ে থাকা অংশ। এই অংশ চামড়া,হাড় এবং সমগ্র জাতীয় পদার্থ দিয়ে তৈরী। এই অংশ ভীষণ ভাবে শক্তপোক্ত। সম্ভবত,এই অংশ ওদেরকে লিঙ্গ নির্ধারণ ও বয়স নিরূপণে সাহায্য করে। এছাড়াও লড়াইয়ের সময় ও গাছের ডালে ধাক্কা মেরে ফল পাড়ার সময় এই শক্ত ঠোঁটের ব্যবহার করে।এতো বড় লম্বা ঠোঁট নিয়ে পাখী গুলো যেন সর্বদা শশব্যস্ত থাকে। পাখিটা যতটা লম্বা ,ঠোঁট সেই পরিমাণে লম্বা হতে দেখা যায়। কোনো কারণে যদি ওদের ঠোঁট ভেঙে যায় তাহলে খাবার খেতে খুব কষ্ট হয়।

খাদ্যাভাস –

মোটামুটি সব ধনেশ পাখিরই খাদ্যাভ্যাস একই রকম বিভিন্ন রকমের ফল ও বেরি খেতে এরা খুব ভালোবাসে। প্রজনন কালে এরা অন্য ছোট ইঁদুর ,কাঠবেড়ালী,সাপ,অন্য পাখির বাচ্চা সবই খেয়ে থাকে নিজের শরীরকে সম্পূর্ণ ভাবে নিউট্রিশন দেবার চেষ্টা করে।

প্রজনন প্রক্রিয়া –

ধনেশ পাখীদের বাসা তৈরী ও সন্তান পালন বড় মজার ব্যাপার। খড়কুটা দিয়ে এরা বাসা বানায় না। ডিম্ পাড়ার সময় হলে এরা গাছের গুড়ির গর্তে কোটর বানিয়ে ,পাথরের খাঁজে অথবা নদীর তীরে মাটির খাড়া অংশে গর্তে বাসা বাঁধে। তারপর স্ত্রী পাখী ওই গর্তে বা বাসায় প্রবেশ করে গর্তের মুখ নিজের বিষ্ঠা দিয়ে বন্ধ করে দেয়। এই গর্তে খুব ছোট্ট একটু ছিদ্র থাকে যার সাহায্যে পুরুষ পাখীটি বাইরে থেকে পোকামাকড় ,ফল প্রভৃতি খাবার সেই ছিদ্রপথের ভেতরে চালান করে দেয়। স্ত্রী পাখীটি তা খেয়ে পেট ভরায়। এই রকম অন্ধকার কোটরে বন্দী থেকে স্ত্রী পাখীটি ডিম্ পাড়ে। ২৫ -৪০ দিন ডিমে তা দেবার পরে শাবকের জন্ম হয়। শাবক জন্মাবার পরেও ওই একই ছিদ্রপথে পুরুষ পাখী খাবারের যোগান দিয়ে যায়। শাবকরা একটু বড় হলে স্ত্রী পাখী বাসার বন্ধ করা মুখ ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসে। প্রজননের সময় ও পরে পুরুষ হর্নবিল অসম্ভব দায়িত্ব সহকারে নিজের কর্তব্য পালন করে। এই পুরো প্রক্রিয়ার সময় প্রচন্ড পরিশ্রমের ফলে পুরুষ পাখির ওজন কমে যায় এবং একটি কোটরে দীর্ঘ দিন থাকার ফলে স্ত্রী পাখিটির অনেক পালক ঝরে যায়। এই সময় যদি কোনো কারণে পুরুষ পাখীটির মৃত্যু হয় তাহলে অনাহারে তার পুরো পরিবারের মৃত্যু হয়। এই ক্ষেত্রে একটি বিষয় বিশেষ উল্লেখযোগ্য, একটি হর্নবিলকে যখন শিকার করা হয় তখন শুধুমাত্র সেই হর্নবিলটির মৃত্যু হয় তা নয়,এতে পুরো পরিবারটির মৃত্যু হয়।

“হরিণা আপন মাংসে বৈরী “,ঠিক তেমনি হর্নবিলকে শিকার করা হয় তার সুন্দর ঠোঁটের জন্য। মানুষের বিলাসিতা ও লালসার শিকার এই হর্নবিল বা ধনেশ পাখী। চোরা শিকার ও বৃক্ষ ছেদনের ফলে এই প্রজাতির পাখী আজ বিলুপ্ত হতে চলেছে। অনেক জায়গায় স্থানীয় লোকেরা পাখীদের ওপরে ভারী অত্যাচার করে। বড় বড় পাখী ধরে তারা তাদের পালক ছিঁড়ে মাথায় পরে এবং ডিম্ ও বাচ্চাগুলোকে খুঁজে পেতে খেয়ে ফেলে। মানুষের এই রকম উপদ্রপের জন্য ধনেশ পাখীর সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। তাছাড়াও, জঙ্গলে জীবনধারণ করা এমন সহজ নয়। নানাধরণের প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় এদের , কখনো কারো সাথে লড়াইয়ে ঠোঁট জখম হয়ে যায় কখনো আবার ঠোঁট ভেঙেও যায়। তাও তারা বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। survival of the fittest .

মানুষ হিসেবে আমাদের এদের প্রতি সদয় ও সচেতন হওয়া উচিত। সময় মতো যদি আমরা এদের সংরক্ষণ না করি তাহলে, খুব শীঘ্রই ডোডো পাখীর মতো এই পাখীও কেবল মাত্র বইয়ের পাতায় ছবি হিসেবে ও জাদুঘরে দেখতে পাওয়া যাবে।

কলমে – অজন্তাপ্রবাহিতা
ছবি ও তথ্য সংগ্রহ -রাহ, নোয়েল ফোনিং ও গৌতম রায়

Indian Grey Hornbill by Gautam Roy
১৩ঐ এপ্রিল ২০২২ উত্তরের সারাদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত

By AjantaPrabahita

Every Story I create creats me.I am determined to be careful and happy in whatever situation I may find myself. I have learned to restore myself.I trust people with my heart, even if it will get broken I am proud of everything that I am and will become. ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *