মুসৌরির কেম্পটি ফলসে কিছুক্ষণ

( সংবাদপত্রে প্রকাশিত )
আমরা ভ্রমণ পিপাসু। ভ্রমণের জায়গা যদি হয় পাহাড় ,সমুদ্র ,জলপ্রপাত কিংবা কোনো শান্ত নদীর তীর তাহলে তো আর কথাই নেই। এমনি এক ছোট্ট ভ্রমণ যাত্রার মধ্যে রয়েছে মুসৌরিতে কাটানো একটি দিন। সময়টা ছিল ,২০২২ এর সেপ্টেম্বর, পিতৃপক্ষ। সপরিবারে ব্যাঙ্গালোর থেকে রওয়ানা হয়ে আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থল ছিল ,হরিদ্বার। সেখানে কিছু পারিবারিক কাজ সারার পর হাতে একটা দিন বেঁচে ছিল। তাই দেরি না করে পরদিন ভোরবেলা হোটেলে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়ের রানী মুসৌরির উদ্দেশ্যে। যার দূরত্ব হরিদ্বার থেকে ১০০ কিলোমিটার।
শহুরে ভিড় কাটাতে আমরা ছুটলাম দেরাদুন এয়ারপোর্ট সংলগ্ন রাস্তা থানে বাইপাস ধরে। রাস্তার দুধারে ছিল পাইন দেবদারুর ঘন বন আর দোসর ছিল মুসল ধারায় বৃষ্টি। লম্বা সফর। পাহাড়ি রাস্তা । গাড়ি ছুটছে স্পিডে। সঙ্গে আছে পঞ্চমদার মনভোলানো গান। বৃষ্টি ,বন আর শ্রুতিমধুর সঙ্গীত সব মিলে মিশে এক অদ্ভুত মাদকতার আবহাওয়া তৈরী করেছিল। আমরা সবাই ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। মাঝে মাঝে বাধ সাধছিলো রাস্তার পাশের গভীর খাদ। মেঘের মাঝখান দিয়ে যেতে যেতে মনে হচ্ছিলো এ কোনো যন্ত্রচালিত গাড়ি নয়, এ যেন মেঘের পালকি।
ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পার হয়ে গেছে। আমরা পৌঁছুলাম কেম্পটি ফলস ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকে আসল ফলসের
দূরত্ব আরো বেশ খানিকটা। পাহাড়ি রাস্তায় একটি মাত্র খাবার দোকান এবং গাড়োয়ালি কর্মকারী জিনিস পত্রের একটি দোকান।
হোটেলে সামান্য কিছু চা জলখাবার খেয়ে কনকনে ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য কিছু গরম কাপড় কিনে বৃষ্টি মাথায় করেই রওয়ানা হলাম কেম্পটি ফলস। প্রায় মিনিট পনেরো কুড়ি মিনিট ড্রাইভের পরে পৌঁছলাম কেম্পটি ফলস মার্কেট। একটা সরু রাস্তা দুপাশে বাহারি দোকানের সমাহার। পাহাড়ি রাস্তা ও বিকট আবহাওয়ার দরুণ আমাদের ছাতা ভাড়া করতে হয়েছিল। রোপওয়ের টিকিট কেটে উঠে বসলাম। অসম্ভব আনন্দ উত্তেজনায় রোপওয়েতে বসে দুধারের পাহাড়ের সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে থাকা কেম্পটি ফলস স্পটের দিকে। কিছুদূর যেতেই ঝর্ণার জল পরার ঝরঝর শব্দ কানে আসছিলো। কেম্পটি ফলস স্পটে নেমেই কেম্পটির সৌন্দর্য্যে কেমন হারিয়ে গেলাম।
সে এক অপূর্ব দৃশ্য। মেঘেদের আনাগোনায় বৃষ্টির লুকোচুরি। অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা, যা শব্দে প্রকাশ করা যায় না।
তবে, স্থানীয় প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমরা কেউই ফলসে নামতে পারি নি। অগত্যা , ফলসের সামনের ছাতার আকারে তৈরী ভিউ পয়েন্ট থেকেই ফলসের সৌন্দর্য্য দেখছিলাম। মনে হচ্ছিলো, কোনো ষোড়শী কিশোরীর বাঁধভাঙা চঞ্চলতা দেখছি চোখের সামনে। যদিও এই ফলস মুসৌরিতে বহমান,এর উৎস স্থল হিমালয়ের অন্য অংশে। সমুদ্রতট থেকে প্রায় ১৩৬৪ মিটার ওপরে প্রকৃতির কোলে এই ফলস।
এই ফলসের বিশেষত্ব , এর দুধ-সাদা জলধারা। বহুবর্ষজীবী জলের স্রোতগুলি প্রায় ৪৫০০ ফুট উচ্চতায় উঁচু পাহাড়ের বন থেকে বেরিয়ে আসে, আরও ৪০ ফুট ক্যাসকেডে বিভক্ত হয়ে অবশেষে একটি পুকুরে পরিণত হয় যা জায়গাটিকে আকর্ষণীয় করে তোলে। পর্যটকরা এই জলপ্রপাতের স্নান করতে ও সাঁতার কাটতে বিশেষ ভাবে ভালোবাসেন।
ব্রিটিশ আমলে জন মেকিনান সাহেব এই কেম্পটির উন্নয়ন করেন। ‘কেম্পটি’ নামটি আসলে দুটি শব্দ ‘ক্যাম্প ( শিবির ) এবং চা’ এর সমাবেশ থেকে উদ্ভূত । ব্রিটিশরা এই স্পটকে ক্যাম্পসাইটের জন্য খুব পছন্দ করতো। সেই ১৮৩৫ থেকে আজও কেম্পটি ফলস পিকনিক স্পট ও পর্যটন গন্তব্য হিসাবে বিখ্যাত।
উৎসাহী হয়ে খবর নিয়ে জানলাম কেম্পটি জলপ্রপাতের চারপাশে ঘন জঙ্গলে অনেক পাখি এবং প্রাণীর আবাসস্থল। কেম্পটি জলপ্রপাত এলাকার কাছে পাওয়া কিছু পাখি হল সাদা ক্রেস্টেড কালিজ ফিজ্যান্ট, তিতির, ব্লু রক পিজন, ফায়ার টেইলড সান বার্ড, হুইসলিং থ্রাশ, হোয়াইট ক্যাপড ওয়াটার রেডস্টার্ট এবং রেড বিল্ড ব্লু ম্যাগপাই। এই এলাকায় মাঝে মাঝে চিতাবাঘেরও দেখা পাওয়া যায় । আশেপাশের বনাঞ্চলেও বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতির বসবাস। প্রতি বছর দেশ ও বিদেশ থেকে বহু ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার এখানে ছবি তুলতে আসেন।
সেদিন বৃষ্টি আর থামলো না। বেশি বৃষ্টিতে পাহাড়ি রাস্তায় ধস নামার সম্ভাবনা থাকে। পাহাড়ি রাস্তা। অতএব দেরি না করে আমরা আবার রোপওয়ে ধরবার জন্য এগিয়ে গেলাম। পথের দুপাশে জমে থাকা প্লাস্টিক , আর আবর্জনা চোখে পড়লো।
উত্তরাখণ্ডের ঘটে যাওয়া বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা আমাদের কারো অজানা নয়। কিন্তু তারপরেও মানুষ সচতন আর হলো না। রাস্তার পাশে থাকা ডাস্টবিনে চিপসের প্যাকেট , খালি বোতল , চায়ের কাপ , খাবারের প্লেট ইত্যাদি না ফেলে সেই রাস্তার ওপরেই ফেলে চলে যাচ্ছে। তারসঙ্গে চোখে পড়লো পাহাড়ের বুকে ক্রমবর্ধমান লজ ও রেস্তোরাঁ।
একইভাবে রোপওয়ে চেপে ফিরে এলাম। ছাতার দোকানে ছাতা ফেরত দিয়ে গাড়িতে বসে ভাবছিলাম , প্রকৃতি আমাদের কত কি দিয়েছে। আমরা তার বদলে কী দিয়েছি ? সামান্য একটু সচতন এবং সহানুভূতিশীল হলেই তো প্রকৃতির ক্রোধের হাত থেকে আমরা বেঁচে পারি।

কিভাবে যাবেন

মুসৌরি থেকে বিভিন্ন ভাবে কেম্পটি ফলস যাওয়া যায়। আগে থেকে বুকিং করা থাকলে কেম্পটি ফলস ছাড়াও মুসৌরির অন্যান্য ট্যুরিস্ট স্পট গুলোতে ঘুরে আসা যায়। তবে ,আবহাওয়া দেখে এখানে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

কোথায় থাকবেন

দেরাদুন ,মুসৌরি ও কেম্পটি ফলসে থাকার জায়গার অভাব নেই। ইন্টারনেটে দেখে নিজের পছন্দ মতো জায়গায় বুকিং করে নিলে কোনো সমস্যা হয় না।
কলমে -অজন্তাপ্রবাহিতা
কেম্পটি ফলসের ছবি – নিজ
রেড বিল্ড ব্লু ম্যাগপাই ( নীল হাঁড়িচাচার) ছবিটি তুলেছেন রাহ।
➖➖➖➖

#sukhobor
#kolkataprimetime