মেঘবালিকা

সান্দাকফু যাবার পথে হিমালয়ের কোলে ছোট্ট গ্রাম কালাপোখরি। ঠান্ডা আবহাওয়ার জন্য গ্রামের জনবসতি এখানে কম। এই গ্রামেই থাকে ছোট্ট মেয়ে মনীষা ।বাকি পাহাড়ীদের মতোই চ্যাপ্টা নাক, ছোট ছোট চোখ,গোল গোল লাল গাল। আর মুখে হাজার বাতির আলোর মতো মন কেড়ে নেওয়া হাসি । সেই পাহাড়ী হাসির দিকে একবার চোখ পড়লে চোখ ফেরানো দায়। মা মুন্নি আর বাবা দীপক গুরুংএর চোখের মণি।
গ্রামের কিছু দূরেই সরকারী স্কুলে ক্লাস থ্রীতে পড়ে মনীষা। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আঁকা বাঁকা রাস্তা দিয়ে বাবার হাত ধরে রোজ স্কুলে আসা যাওয়া করে। সেই সময় বাবার কাছে নানারকম গল্প শোনে। একদিন বুবাকে (নেপালি ভাষায়,বাবা ) জিজ্ঞেস করে, ‘আমাদের গ্রামের নাম কালাপোখরি কেন ?’
“পোখরি মানে পুকুর, আর ওখানকার জলের রং কালো বলে নাম হয়েছে কালাপোখরি”।
পাহাড়ের চড়াই উৎরাইয়ের লম্বা রাস্তা পার করতে গিয়ে প্রায়ই মনীষার ছোট্ট পা ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
বুবা তখন ওকে পর্বত কন্যা , জুনকো তাবেই,অরুনিমা সিনহা,ছন্দা গায়েন সবার পর্বত বিজয়ের গল্প শোনান।
বলেন, “দেখ মা। ওঁরা সমতলের মেয়ে হয়েও নিজের নিরলস চেষ্টায় কেমন এভারেস্ট জয় করেছেন। আর তুই তো পাহাড়ি মেয়ে, এইটুকু পথ হেঁটে পার করতে পারবি না ?”
বুবার কথা শুনে ছোট্ট পায়ে জোর এনে আবার হাঁটতে শুরু করে আর মনে মনে ভাবে, একদিন ওকেও ওই উঁচু পর্বতের শিখরে পৌঁছতেই হবে। কত নাম ডাক হবে তখন। সবাই বলবে, “পাহাড়ী কন্যা মনীষা কেমন পর্বতকে জয় করেছে। তাই যেমন করেই হোক, হেঁটে বাড়ি পৌঁছাতেই হবে। ক্লান্ত হয়ে পড়লে চলবে না।”
একদিন, বিরাট পাহাড়ের কোলে অনেক জমে থাকা মেঘ দেখে অবাক হয়ে বুবাকে জিজ্ঞেস করে, “অতো মেঘ ওখানে কেন ?” দীপক বলেন, “বেটি, ওটা মেঘেদের রাজ্য। পাহাড়ের চূড়ায় মেঘেদের রাজা থাকেন, নাম তার মেঘরাজ। প্রতিদিন মেঘেরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা খবর নিয়ে মেঘরাজের দরবারে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে।মেঘরাজ খবর নেন, সময়মতো সব জায়গায় বৃষ্টিপাত হচ্ছে কি না। কোথাও যদি কম বৃষ্টি হয়, তাহলে চাষীদের ফসল ফলাতে খুব কষ্ট হবে। তাই মেঘেদের বলা হয়, যত কষ্ট হোক না কেন তারা যেন দূর দূরান্তে উড়ে গিয়ে সময়মতো বৃষ্টি হয়ে মাটির বুকে ঝরে। সব দিকেই ওঁনার কড়া নজর থাকে। ওঁনার রাজ্যে কোনো শোক নেই, সবাই খুব সুখে শান্তিতে বাস করে।”

  • মেঘের রাজা কেমন দেখতে,বুবা।
    -মেঘরাজ খুব সুন্দর দেখতে, লম্বা সুঠাম চেহারা ,ফর্সা টকটক করছে গায়ের রং। ওঁনার পোশাক লাল আলখাল্লার ওপরে সাদা পশমের লম্বা কোট। মাথায় সোনার রাজ মুকুট আর হাতে মানদণ্ড। উনি সবার ন্যায় বিচার করেন। সকাল বেলা ভোরের প্রথম সূর্য্য কিরণ যখন ওনার রাজমুকুটে পরে, সেই মুকুট থেকে সোনালী রং ছিটকে পরে বাকি পাহাড় চূড়ার ওপর।
    বাবার মুখে মেঘরাজের বর্ণনা শুনে মনীষার কৌতূহল বেড়েই চলে, প্রশ্নের ঝুলি আর শেষ হয় না।
    একটা অল্প উঁচু পাহাড়ের চাইয়ের ওপর অরুণের ছোট্ট কাঠের বাড়ি। ঘরের সর্বত্রই অর্থকষ্টের আভাস রয়েছে । রোজগার বলতে বাড়ির সাথে লাগোয়া ছোট্ট চায়ের দোকান। তার থেকে যা রোজগার হয় তাতে কোনোমতে দিন চলে যায়।
    সারা বছর পাহাড়ে ঘুরতে আসা ট্যুরিস্টের ওপর নির্ভর করেই রোজগার হয়। ট্যুরিস্ট মানেই ওদের কাছে ভগবান।
    সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী মুন্নি খাবার বানিয়ে চলে। দীপক একটা রংচটা জিন্‌স প্যান্ট ও বেশ পুরোনো সোয়েটার ও কাঁধের এক পাশে একটি ছোট তোয়ালে ঝুলিয়ে এই টেবিল থেকে ওই টেবিল অর্ডার নিতে ও সার্ভ করার জন্য ছুটে বেড়ায়। মনীষাও স্কুল থেকে ফিরে ছোট্ট ছোট্ট হাতে যতটা সম্ভব মা ও বাবার কাজে সাহায্য করে।
    প্রায় সারা বছরই ট্রেকিং ও বেড়ানোর জন্য দেশ বিদেশ থেকে ট্যুরিস্ট আসে যায়। ওদের দোকানে খাবার খেতে এসে তারাও নানা রকম গল্প বলে। মনীষা চুপটি করে দাঁড়িয়ে শোনে,এই গল্প গুলো শিশুমনকে নানারকম কল্পনায় ভরে দেয়।
    দুপুর শেষে দিনের আলো যখন নিস্তেজ হয়ে আসে, পাহাড় থেকে টুকরো টুকরো দলে মেঘেরা তখন নেবে এসে ঘরের ভেতরে উড়ে বেড়ায়। মনে হয় যেন হাত বাড়ালেই ধরে ফেলা যাবে তাদের। ধরতে গেলেই হুউউশশ করে উড়ে যায়। আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে মনীষা মেঘেদের সঙ্গে সারা ঘরে দৌড়ে বেড়ায়। “বুবা, দেখো কত মেঘ ঘরে উড়ে বেড়াচ্ছে।”
    ” হ্যা ! তাইতো , মেঘরাজের আদেশে মেঘেরা তোমার সাথে খেলা করবার জন্য এসেছে। তোমায় বলেছিলাম না,মেঘরাজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবার খবর নেন।”
    “সত্যি বলছো বুবা, এদের মেঘরাজ পাঠিয়েছেন ?”
    “হ্যা রে।”
    ” তুই ওঁর সবচেয়ে প্রিয় মেঘবালিকা কি না, তাই তোর মনের ইচ্ছের কথা উনি জানতে পারেন । আর সেই ইচ্ছে পূরণ করার জন্য মেঘরাজ তোর কাছে মেঘেদের পাঠিয়েছেন। “
    বিস্ময়ে বড়ো বড়ো চোখ করে মনীষা আবার জিজ্ঞেস করে, “আমার সব ইচ্ছে মেঘরাজ জানতে পারেন?”
    “হ্যাঁ রে মা।”
    বাবার উত্তরে গদগদ হয়ে মনীষা আবার মেঘেদের সঙ্গে খেলায় জুটে যায়।
    এমনি করেই বাবা মায়ের আদরে ভালোবাসায় মনীষার দিন কাটছিলো। হেঁটে হেঁটে বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া আসা। হোটেলে বাবা মায়ের সাথে কাস্টোমার সামলানো। সময়মতো স্কুলের কাজ। মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে তাকিয়ে থেকে মনেমনে দূরে এভারেস্টের মাথায় বাস করা মেঘরাজের সাথে মনের কথা বলা।
    বছর 2020 ঢুকতেই কেমন যেন সব পাল্টে গেলো। কোভিড ১৯ নামের এক অদৃশ্য দানবের নাম শুনলো,মনীষা।
    অক্টোপাসের মতো এরও অনেক গুলো পা আছে। এ প্রথমে মানুষের গলায় বাসা বাঁধে, তারপর ফুসফুসকে আক্রমণ করে। এর হাত থেকে বাঁচা খুব মুশকিল। সব শুনে খুব অবাক হয়ে যায়। মনে মনে শঙ্কাও হয়, এবার কি হবে ?
    চারিদিকে লকডাউন হতেই মনীষার স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। পাহাড়ে ট্যুরিস্ট আসা বন্ধ হয়ে গেলো। মা -বাবাকে আর রান্নাঘর ও খদ্দেরের টেবিলে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা যায় না। রোজই চাপা গলায় মা বাবাকে বলেন, ‘আমরা তো জল খেয়ে থেকে যাবো। কিন্তু মেয়েটাকে না খাইয়ে রাখি কি করে ? আস্তে আস্তে জমানো টাকা যে শেষ হয়ে আসছে। ছোট মনীষা বুঝতে পারে রোজগার বিহীন বাবা মায়ের কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু, কি করলে সব ঠিক হয়ে যাবে ও বুঝতে পারে না। তখন বুবার কথা মনে পড়ে, আর দেরি না করে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে একটা চিঠি লেখে।
    আমার প্রিয় মেঘরাজ,
    তুমি তো আমার খুব ভালো বন্ধু। না চাইতেই তুমি আমার সব ইচ্ছা পূরণ করো। তোমার পাঠানো মেঘেদের সাথে আমি রোজ খেলা করি।
    জানো, লকডাউন হওয়াতে আমাদের দোকানে কোনো খদ্দের আসে না তাই রোজগারও হয় না। বাবামায়ের খুব চিন্তা, আমায় কি খাওয়াবে ? তুমি বাবা মায়ের সব চিন্তা ও কষ্ট দূর করে দাও। এই দুষ্টু করোনা ভাইরাসকে মেরে ফেলো।
    আমি বড় হয়ে অন্যান্য পর্বত কন্যাদের মতো তোমার সাথে দেখা করতে যাবো ।
    আমি তোমায় এত্ত ভালোবাসি।
    ইতি
    তোমার প্রিয় মেঘবালিকা, মনীষা
    দুপুরবেলা সবাই ঘুমিয়ে পড়লে দৌড়ে রাস্তার ওপাশে থাকা ডাক বাক্সে চিঠি খানা ফেলে আসে। বুবার কাছে শুনেছিলো মেঘরাজ উত্তর পাঠান মেঘপিয়নের হাতে। রোজ বিকেল হলেই জানলার ধারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে মেঘপিয়নের। মনে দৃঢ় বিশ্বাস, আজ না হোক কাল মেঘরাজের উত্তর আসবেই আসবে ।

অজন্তাপ্রবাহিতা

(অজন্তা বিশ্বাস )
(অমিয় ভৌমিক স্বর্ণ কলম পুরস্কার প্রাপ্ত -(সিনে রাইটিং) বাইশের বায়োস্কোপ। IIMF কলকাতা ২০২২ সেসন- ৪ )?