?️
কলমে – অজন্তাপ্রবাহিতা
〰️〰️〰️〰️〰️〰️〰️〰️
(আজকের সংবাদ পত্রে প্রকাশিত)
বাঙালিরা যেমন সাহিত্য প্রেমী তেমনি ভ্রমণ পিপাসু। আমরাও ব্যতিক্রম নই। ভ্রমণের জায়গা যদি হয় পাহাড় ,সমুদ্র ,জলপ্রপাত কিংবা কোনো শান্ত নদীর তীর তাহলে তো আর কথাই নেই। এমনি এক ছোট্ট ভ্রমণ যাত্রার মধ্যে রয়েছে মুসৌরিতে কাটানো একটি দিন। সময়টা ছিল ,২০২২ এর সেপ্টেম্বর, পিতৃপক্ষ। সপরিবারে ব্যাঙ্গালোর থেকে রওয়ানা হয়ে আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থল ছিল ,হরিদ্বার। সেখানে কিছু পারিবারিক কাজ সারার পর হাতে একটা দিন বেঁচে ছিল। তাই দেরি না করে পরদিন ভোরবেলা হোটেলে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়ের রানী মুসৌরির উদ্দেশ্যে। যার দূরত্ব হরিদ্বার থেকে ১০০ কিলোমিটার।
(১)
শহুরে ভিড় কাটাতে আমরা ছুটলাম দেরাদুন এয়ারপোর্ট সংলগ্ন রাস্তা থানে বাইপাস ধরে। রাস্তার দুধারে ছিল পাইন দেবদারুর ঘন বন আর দোসর ছিল মুসল ধারায় বৃষ্টি। লম্বা সফর। পাহাড়ি রাস্তা । গাড়ি ছুটছে স্পিডে। সঙ্গে আছে পঞ্চমদার মনভোলানো গান। বৃষ্টি ,বন আর শ্রুতিমধুর সঙ্গীত সব মিলে মিশে এক অদ্ভুত মাদকতার আবহাওয়া তৈরী করেছিল। আমরা সবাই ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। মাঝে মাঝে বাধ সাধছিলো রাস্তার পাশের গভীর খাদ ও তীক্ষ্ণ বাঁক। মেঘের মাঝখান দিয়ে যেতে যেতে মনে হচ্ছিলো এ কোনো যন্ত্রচালিত গাড়ি নয়, এ যেন মেঘের পালকি।
✴️ঘন মেঘের মাঝে ছুটছে গাড়ি দেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পেরিয়ে গেছে। আমরা পৌঁছুলাম কেম্পটি ফলস ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকে আসল ফলসের দূরত্ব আরো বেশ খানিকটা। পাহাড়ি রাস্তায় একটি মাত্র খাবার দোকান এবং গাড়োয়ালি কর্মকারী জিনিস পত্রের একটি দোকান।
✴️হোটেলে সামান্য কিছু চা জলখাবার খেয়ে কনকনে ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য কিছু গরম কাপড় কিনে বৃষ্টি মাথায় করেই রওয়ানা হলাম কেম্পটি ফলস। প্রায় মিনিট পনেরো কুড়ি মিনিট ড্রাইভের পরে পৌঁছলাম কেম্পটি ফলস মার্কেট। একটা সরু রাস্তা দুপাশে বাহারি দোকানের সমাহার। পাহাড়ি রাস্তা ও বিকট আবহাওয়ার দরুণ আমাদের ছাতা ভাড়া করতে হয়েছিল। রোপওয়ের টিকিট কেটে উঠে বসলাম । অসম্ভব আনন্দ উত্তেজনায় রোপওয়েতে বসে দুধারের পাহাড়ের সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম আরেক পাহাড়ের চূড়ায় কেম্পটি ফলস স্পটের দিকে। কিছুদূর যেতেই ঝর্ণার জল পরার ঝরঝর শব্দ কানে আসছিলো। কেম্পটি ফলস স্পটে নেমেই কেম্পটির সৌন্দর্য্যে কেমন হারিয়ে গেলাম।
সে এক অপূর্ব দৃশ্য। মেঘেদের আনাগোনায় বৃষ্টির লুকোচুরি। অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা, যা শব্দে প্রকাশ করা যায় না।
✴️তবে, স্থানীয় প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমরা কেউই ফলসে নামতে পারি নি। অগত্যা , ফলসের সামনের ছাতার আকারে তৈরী ভিউ পয়েন্ট থেকেই ফলসের সৌন্দর্য্য দেখছিলাম। মনে হচ্ছিলো, কোনো ষোড়শী কিশোরীর বাঁধভাঙা চঞ্চলতা দেখছি চোখের সামনে। যদিও এই ফলস মুসৌরিতে বহমান,এর উৎস স্থল হিমালয়ের অন্য অংশে। সমুদ্রতট থেকে প্রায় ১৩৬৪ মিটার ওপরে প্রকৃতির কোলে এই ফলস।
✴️এই ফলসের বিশেষত্ব , এর দুধ-সাদা জলধারা। বহুবর্ষজীবী জলের স্রোত গুলি প্রায় ৪৫০০ ফুট উচ্চতায় উঁচু পাহাড়ের বন থেকে বেরিয়ে আসে, আরও ৪০ ফুট ক্যাসকেডে বিভক্ত হয়ে অবশেষে একটি পুকুরে পরিণত হয় যা জায়গাটিকে আকর্ষণীয় করে তোলে। পর্যটকরা এই জলপ্রপাতের স্নান করতে ও সাঁতার কাটতে বিশেষ ভাবে ভালোবাসেন।
?ব্রিটিশ আমলে জন মেকিনান সাহেব এই কেম্পটির উন্নয়ন করেন। ‘কেম্পটি’ নামটি আসলে দুটি শব্দ ‘ক্যাম্প এবং চা’ এর সমাবেশ থেকে উদ্ভূত । ব্রিটিশরা এই স্পটকে ক্যাম্প সাইটের জন্য খুব পছন্দ করতো। সেই ১৮৩৫ থেকে আজও কেম্পটি ফলস পিকনিক স্পট ও পর্যটন গন্তব্য হিসাবে বিখ্যাত।
?উৎসাহী হয়ে খবর নিয়ে জানলাম কেম্পটি জলপ্রপাতের চারপাশে ঘন জঙ্গলে অনেক পাখি এবং প্রাণীর আবাসস্থল। কেম্পটি জলপ্রপাত এলাকার কাছে পাওয়া কিছু পাখি হল সাদা ক্রেস্টেড কালিজ ফিজ্যান্ট, তিতির, ব্লু রক পিজন, ফায়ার টেইলড সান বার্ড, হুইসলিং থ্রাশ, হোয়াইট ক্যাপড ওয়াটার রেডস্টার্ট এবং রেড বিল্ড ব্লু ম্যাগপাই। এই এলাকায় মাঝে মাঝে চিতাবাঘেরও দেখা পাওয়া যায় । আশেপাশের বনাঞ্চলেও বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতির বসবাস। প্রতি বছর দেশ ও বিদেশ থেকে বহু ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার এখানে ছবি তুলতে আসেন।✴️
?️সেদিন বৃষ্টি আর থামলো না। বেশি বৃষ্টিতে পাহাড়ি রাস্তায় ধস নামার সম্ভাবনা থাকে। পাহাড়ি রাস্তা। অতএব দেরি না করে আমরা আবার রোপওয়ে ধরবার জন্য এগিয়ে গেলাম। এবারে গন্তব্য স্থল আরকেটি জলপ্রপাত ,ভাট্টা ফলস।

(২) ভাট্টা ফলস⏬

মুসৌরি শহর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে মুসৌরির ভাট্টা রোডে এই ভাট্টা জলপ্রপাত। স্থানীয় এবং পর্যটক দুইয়ের কাছেই কাছে এক আকর্ষণীয় এবং প্রধান পিকনিক স্পট। এখানেও রোপওয়েতে করে ফলসে যেতে হয়। তবে , কেম্পটি ফলস থেকে ভাট্টা ফলসের পরিবেশ একদম আলাদা। এখানে পাহাড়ের নিচ দিয়ে প্রবাহিত জলের প্রাকৃতিক স্রোত রয়েছে।
ঘড়ির কাঁটা চারটে ছুঁই ছুঁই আমরা পৌছালাম ভাট্টা ফলস। বৃষ্টি কিছুক্ষনের জন্য বিরাম নেওয়াতে আরাম করে ভাট্টা ফলস পার্কে বেড়াতে পারলাম। বাচ্চাদের আকর্ষণ করার জন্য এখানে নানারকম রাইড ও বোটিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে ,সাথে রয়েছে গাড়োয়ালি খাবারের হোটেল।
স্থানীয় খাবার ও মশলা চা সহযোগে বিকেলের খাবার বেশ জম্পেশ ভাবে খেয়ে কিছু ফটো সেশন করতে না করতেই আবার দাপিয়ে বৃষ্টি এলো। বৃষ্টিতে রোপওয়ে চলে না। কাজেই হোটেলে বসে বৃষ্টি , পাহাড় , ঝর্ণা দেখতে লাগলাম। যদিও ভাট্টা জলপ্রপাতটির আধুনিকীকরণ করা হয়েছে তবু এই স্থানটি এখনো তীব্র বাণিজ্যিকরণ থেকে বেঁচে রয়েছে।
⚠️ তবে, আধুনিকীকরণের ফলস্বরূপ কেম্পটি ফলসের চারিপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের হানি ঘটেছে একথা অনস্বীকার্য।
আসলে মানুষ বড় স্বার্থপর। যেই প্রকৃতি দুহাত ভরে উজাড় করে মানুষকে উপহার দিয়েছে তারই বিনাশ করার সময় আমরা কেউ মুহূর্তের জন্যেও ভাবি না। উত্তরাখণ্ডের ঘটে যাওয়া বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা আমাদের কারো অজানা নয়। সম্প্রতি করোনা মহামারী হবার পরেও আমাদের স্বভাব ও চিন্তার কোনও পরিবর্তন হয়নি। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে গাড়িতে
বসলাম।⚠️
?️দিনের আলো নিভে আসছে সঙ্গে বৃষ্টি। কাজেই বাকি ফলস গুলোতে আর যাওয়া হলো না। ইচ্ছে ছিল লাল টিব্বা, গান হিল পয়েন্ট , মুসৌরি লেক ইত্যাদি দেখে ফেরার। ভবিষ্যতের খাতায় এই নাম গুলো তুলে রেখে এগোলাম দেরাদুনের রাস্তায়।?️
(৩)

অনবদ্য শিব মন্দির ⏬

?পথের এক বাঁকে পড়লো উত্তরাখণ্ডের বিখ্যাত শ্রী প্রকারেশ্বর শিব মন্দির। মন্দিরটি অন্য মন্দির থেকে বেশ আলাদা।
এই মন্দিরের বিশেষত্ব, এখানে কোনো দান-দক্ষিণা গ্রহণ করা হয় না। ‘প্রকাশ’ এবং ‘ঈশ্বর ‘ এই দুই শব্দের মিলনে ‘প্রকারেশ্বর’। ভগবান শিব থেকেই জ্ঞানের প্রকাশ হয় । কথায় বলে, শিবশক্তি তিনি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়রূপ তিন কারণের কারণ,তিনি কালচক্র ও সংসারের সকল গুণ-অগুণ এর উর্দ্ধে। তাঁর দর্শন মাত্রেই মন শান্ত হয়ে যায়।
মন্দিরে প্রবেশ করতেই মন এক অদ্ভুত আনন্দে ভরে উঠলো। মন্দিরের প্রবেশ দ্বারে শিলালিপিতে হিন্দী ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাতেও মন্দিরের নিয়মাবলী লেখা ছিল। বাঙালির ভ্রমণ নেশা সর্বজনবিদিত। মন্দিরে ফটোগ্রাফি নিষেধ।?
শিবের মাথায় জল ঢালার জন্য বালতি ও ঘটি রাখাই আছে। জল ছাড়া অন্য কোনো ধরণের অর্ঘ্য দেবার নিয়ম নেই। এমনকি প্রণামীর বাক্স নেই। ভক্তদের প্রসাদ স্বরূপ চা ,ক্ষীর ,চানা এবং পুরী দেয়া হয়। এখানে নিয়মিত লঙ্গর খাওয়ানো হয়। মন্দিরের প্রাঙ্গণে দু -তিনখানা দোকান আছে যাতে রুদ্রাক্ষ ও অন্য রত্ন পাওয়া যায়।
মহাদেবের আশীর্বাদ নিয়ে আমরা আর দেরি করলাম না। আবার যেন দর্শন পাই এই প্রার্থণা করে এগিয়ে গেলাম দেরাদুনের দিকে। সেখানে বেশ গরম ছিল। কাজেই গরম জামা খুলে ফেলতে হলো। হরিদ্বার হোটেলে যখন পৌছালাম তখন বাজে রাত দশটা। পরদিন সকালে ব্যাঙ্গালোর ফ্লাইট। কাজেই গোছগাছ করতে লেগে গেলাম। মনে হচ্ছিলো ,স্বর্গ দর্শন করে ফিরলাম। কাল থেকে আবার গতানুগতিক জীবনের ছন্দে ফেরা। ?
(৪)

কিভাবে যাবেন ✈️

মুসৌরি থেকে বিভিন্ন ভাবে কেম্পটি ফলস যাওয়া যায়। আগে থেকে বুকিং করা থাকলে কেম্পটি ফলস ছাড়াও মুসৌরির অন্যান্য ট্যুরিস্ট স্পট গুলোতে ঘুরে আসা যায়। তবে ,আবহাওয়া দেখে এখানে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

কোথায় থাকবেন ?

দেরাদুন ,মুসৌরি ও কেম্পটি ফলসে থাকার জায়গার অভাব নেই। ইন্টারনেটে দেখে নিজের পছন্দ মতো জায়গায় বুকিং করে নিলে কোনো সমস্যা হয় না।
কলমে -অজন্তাপ্রবাহিতা

published in Jugosonkhyo

By AjantaPrabahita

Every Story I create creats me.I am determined to be careful and happy in whatever situation I may find myself. I have learned to restore myself.I trust people with my heart, even if it will get broken I am proud of everything that I am and will become. ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *