এক কিংবদন্তী বাঘিনী

আজ এক বাঘিনীর গল্প বলি। বন্যপ্রেমীদের কাছে খুবই পরিচিত এই বাঘিনী, কলারওয়ালী।  কিন্তু , যারা জানেন না, তাদের জন্য এই অসাধারণ বাঘিনীর জীবনের গল্প বলছি।  অভিনেত্রী সম্ভাবনা শেঠের ব্লগ থেকে আমি এর কথা জানতে পারি , তারপর থেকেই এর খবর রাখার চেষ্টা করতাম। ২০২২ এর ১৯শে জানুয়ারী ষোলো বছর থেকে একটু বেশি বয়সে এই বাঘিনী মারা যায়।

বনাঞ্চল পেঞ্চ টাইগার রিজার্ভ  সাম্প্রতিক কালের অনেক জনপ্রিয় বাঘের সাক্ষী। তবে 2005 সালে জন্ম নেওয়া ম্যাজেস্টিক কলারওয়ালি (T-15)  এদের মধ্যে সেরা। বিখ্যাত টাইগ্রেস  বড়ি মাদা  ( বড় মা ) T -7 এবং  T-1 টাইগার চার্জারের কোদালের (একটি আক্রমণাত্মক এবং প্রভাবশালী পুরুষ বাঘ) কন্যা এবং অন্য 3টি বাঘের (2টি পুরুষ এবং 1টি মহিলা) বোন এই কলারওয়ালি।  বাবা T-1  পেঞ্চ টাইগার রিজার্ভের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বাঘদের একজন এবং ঠিক তার বাবার মতোই সে পেঞ্চ টাইগার রিজার্ভের পুরো শিকার অঞ্চলে আধিপত্য ও শাসন করেছিল।  

কলারওয়ালির মা বড়ি মাদা (বড় মা) একটি শক্তিশালী বাঘিনী হিসাবে পরিচিত ছিল। তার বার বছরের মাতৃত্বকালে ঊনিশটি বাচ্চা প্রসব করেছিল। বংশগত ভাবেই কলারওয়ালিও অসম্ভব শক্তিশালী জিনসম্পন্ন উনিশটি বাচ্চার জন্ম দিয়েছিলো।  পেঞ্চ টাইগার রিজার্ভ এখন বেশ কয়েকটি শক্তিশালী বাঘ এবং সুস্থ শাবকের আশ্রয়স্থল।

বাঘের ব্যাপারে খোঁজ করতে গিয়ে বেশ কয়েকটি মজাদার ব্যাপার জানতে পারি। বাঘিনী তিন ও বাঘ চার বছর বয়সে প্রজননক্ষম হয়।  বাঘিনী একসঙ্গে ২-৫টি বাচ্চা প্রসব করে। গর্ভকাল আনুমানিক ১৪-১৫ সপ্তাহ। অধিকাংশ বাচ্চাই ফেব্রুয়ারি-মে মাসের মধ্যে জন্মায়। মায়ের যত্নেই ৪-৫ মাস লালিত-পালিত হয়। বাচ্চারা এক বছর বা আরও একটু বেশি সময় মায়ের সঙ্গে থাকে। জন্মের পরে, বাঘের বাচ্চারা সাধারণত ছ’মাসে স্বাবলম্বী হয়। এর আগে তাদের দেখাশোনা পুরোটাই মা বাঘ করে। জন্মদাতা বাঘ কোনো দায়িত্ব পালন করে না। বরং অনেক সময় নিজের বাচ্চাকে খেয়েও ফেলে। বিখ্যাত বাঘ শিকারি জিম করবেট বলেছেন, বাচ্চারা জন্মের পরে মায়ের সাথে আঠেরো মাস বয়স পর্যন্ত থাকে।  নিজেরা চলাফেরা শেখার পরে তারা তাদের মাকে ছেড়ে চলে যায় এবং নিজেদের মতো করে একটা এলাকা বেছে নিয়ে  স্বাধীন ভাবে বসবাস করা শুরু করে।  বাবা মা ভাই বোন  আত্মীয় স্বজন কারো সঙ্গেই ওদের সম্পর্ক থাকে না। বোনের সঙ্গে ভাই সঙ্গম করে, বোনপোর সাথে মাসী। একা আসে একা যায়।  খিদে পেলে শিকার করে খায় ,মিলনের বাসনা হলেই সঙ্গী/সঙ্গিনী খুঁজে দিন কয় সাধ মিটিয়ে আবার যে যার পথে হেঁটে যায়। ভাবের কারবার করতে গিয়ে মানুষের মতো মানসিক চড়াই উৎরাইয়ে পথ হারায় না।  রক্ত মাংসের জীবন হওয়া সত্ত্বেও এরা এক দারুণ স্বাধীন-স্বনির্ভর জীবনের অধিকারী।

এবার কলারওয়ালির কথা।সাতটি লিটার এবং ছাব্বিশটি  শাবক নিয়ে, কলারওয়ালি তার বাচ্চাদের সর্বোত্তম খাবার নিশ্চিত করেছে, তাদের পুরুষ-বাঘ থেকে রক্ষা করেছে। পেঞ্চ ন্যাশনাল পার্কের কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেন যে কলারওয়ালিই বিশ্বের একমাত্র বাঘিনী নিজের জঙ্গলে যার অবদান ছাব্বিশটি শাবক। এটি একটি বিশ্ব রেকর্ড।

       এবারে আসি বাঘ গোণা হয় কিভাবে ? বাঘ গোণা  কিন্তু খুব সহজ কাজ নয় । ছোট্ট করে এখানে বাঘ গণনার ব্যাপারে বলি ,অনেক বছরের রিসার্চের পরে দেখা গেছে  প্রতিটি বাঘের গায়ের ডোরার নকশা একেবারেই আলাদা। বাঘের ডোরাকাটা দাগ শুধু তার লোমে না, চামড়াতেও থাকে। বায়োমেট্রিক যুগে  মানুষের আঙ্গুলের ছাপ বা চোখের ছবি  যেমন স্বতন্ত্র, ঠিক সেইরকম দুটো বাঘের চামড়ার ওপরের ডোরাকাটা দাগের নকশাও কখনোই  এক হয় না। যার ফলে বাঘেরা খুব সহজেই একে অপরকে শনাক্ত করতে পারে। এই নিভৃতচারী বাঘের ডোরা পরীক্ষা কিভাবে করা যায়  এ চিন্তা থেকেই শুরু হয় ক্যামেরা ট্র্যাপের ব্যবহার। এ ছাড়া বাঘের গলায় রেডিও কলার পরিয়ে তাদের আঞ্চলিক পরিধিও জানতে পারা যায়।
 এই বাঘিনীর বনবিভাগের দেওয়া সরকারী নাম ছিল T -15  , কিন্তু স্থানীয় লোকেরা তাকে আদর করে ‘কলারওয়ালি’ বলেই ডাকত।  2008 সালে  এই বাঘিনীর  রেডিও কলার লাগানো হয়। রেডিও কলার লাগানো পার্কের প্রথম বাঘিনী হওয়ার কারণেই সে   “কলারওয়ালি “ খেতাব অর্জন করে।

 T-15 ওরফে কলারওয়ালি ‘পেঞ্চের মা ‘ হিসেবেও  পরিচিত। বনবিভাগে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে এই বাঘিনীর নাম উল্লেখ করা হয় কারণ  এগারো বছরের ব্যবধানে (২০০৮-২০১৮) আটটি লিটারে ঊনত্রিশটি শাবকের জন্ম দেওয়া  ভারতে বাঘের জনসংখ্যার গণনায় একটি বড় অবদান। ঊনত্রিশটির মধ্যে মাত্র পঁচিশটি বাঘ জীবিত আছে বলে জানা যায়।  এই উচ্চ প্রজনন ক্ষমতার জন্য তাঁকে ‘সুপার-মম’ খেতাব দেয়া হয়েছিল। একবারে পাঁচটি শাবকের জন্ম দেওয়া একটি বাঘের পক্ষে খুব বিরল নিদর্শন ।

বাঘ বিশেষজ্ঞদের মতে  প্রজননে কলারওয়ালির অসাধারণ সাফল্যের কারণ তার শাবকদের অন্যান্য বাঘের চেয়ে অনেক আগে থেকে আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো। কলারওয়ালি নিজেও একটি খুব  বিশালাকার ,শক্তিশালী এবং হিংস্র বাঘ, তার বেশিরভাগ শাবক বেঁচে গেছে এবং সুস্থ ও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। সে তার সমস্ত ছোট বাচ্চাদের খুব যত্ন নিয়েছে, তাদের রক্ষা করেছে এবং  তার একটি আশ্চর্যজনক অভ্যাস হলো  উপ-প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের থেকে নিজেকে দূরে রাখা, যাতে, তারা  নিজের থেকে আত্মরক্ষার কৌশলগুলিকে রপ্ত করে নিয়ে আত্মনির্ভর হতে পারে। সন্তানরা  দ্রুত স্বাবলম্বী হয়ে ওঠায় কলারওয়ালী  নিয়মিত পুনরুৎপাদন করার জন্য  সময় দিতে পারে।

 নিজের  শর্তে এই বাঘিনী ষোলো বছরের ওপর বেঁচে থেকে রানীর মতোই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। বন্যপ্রাণী প্রেমীরা তাকে স্নেহের সাথে “মাতরম” বা “শ্রদ্ধেয় মা” বলে থাকেন – এই নাম তার জীবদ্দশায় অর্জিত।

কলারওয়ালী ‘সুপার মম বাঘিনী ‘ ,কোনো সাধারণ বেড়াল প্রজাতির প্রাণী নয়। পেঞ্চ অভয়ারাণ্যের ভাগ্য পরিবর্তনে এই বাঘিনীর  ভূমিকা অনেক। মধ্যপ্রদেশ  ‘টাইগার স্টেট্’ পরিচয় পায় এই সুপার মমের অবদানের কারণে।  মধ্যপ্রদেশের বন সবসময় পেঞ্চ টাইগার রিজার্ভের ‘রাণী’-র শাবকের গর্জনে অনুরণিত হবে।

এই অসাধারণ বাঘিনীর জীবন কাহিনী জানার পর মনে হয়, মানুষের মতো মানুষ হতে না পারলে  শক্তিশালী বাঘিনী হওয়াই বোধহয় ভালো ছিল।

অজন্তাপ্রবাহিতা

তথ্য সংগ্রহ – ইন্টারনেট ও জিমকরবেটের লেখা বিভিন্ন বই। 

Photo Credit: Google Images

By AjantaPrabahita

Every Story I create creats me.I am determined to be careful and happy in whatever situation I may find myself. I have learned to restore myself.I trust people with my heart, even if it will get broken I am proud of everything that I am and will become. ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *