কলমে- অজন্তাপ্রবাহিতা
(শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। সব চরিত্র কাল্পনিক। ১৭ জুলাই ২০২২ যুগশঙ্খ সংবাদপত্রের রবিবাসরীয়তে প্রকাশিত। )


ফ্ল্যাটের সদরদরজার কীহোলে চাবিটা লাগিয়ে উল্টো দিকে ঘোরানোর আগেই লবির আলো নিভে গেলো। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোতেই ঠাওর করে নিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো শান্তনু। দরজার পাশের দেয়াল জুড়ে সাজিয়ে রাখা সোফায় বসতেই গা এলিয়ে দিলো। আজ বোধহয় একটু বেশি ড্রিংক হয়ে গেছে। তথাগতের সঙ্গে প্রায় দুবছর বাদে দেখা হলো। কোভিড আর সোশ্যাল ডিস্টেন্সিঙ মেন্টেন করতে গিয়ে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করার অভ্যেসটাই চলে গ্যাছে। এতো দিনের জমে থাকা গল্পের জেরে গ্লাস গোনার কথা মনেই ছিল না।
জানলার কাঁচ দিয়ে বিদ্যুতের আলো এসে পড়ছে ঘরে। সোফার পাশে টেবিলের ওপরে রাখা ইন্টারকম থেকে সিক্যুরিটিকে ফোন করার চেষ্টা করলো। যাহ ! বাবা ! পাওয়ার নেই তো ইন্টারকম চলছে না। মোবাইল থেকে মেনগেটের সিকিউরিটিকে কল করে ডিজির কথা জিজ্ঞেস করলো। সিকুইরিটি জানালো , ডিজির ঘরে জল ঢুকেছে ,সেই জল বের করা না অব্দি ডিজি চালানো সম্ভব নয়।
কোই বাত নেহি। আমি একা মানুষ। আলো থাকুক বা না থাকুক কিছু এসে যায় না ভাই। এই বলে
ফোন রেখে সোফাতেই পা লম্বা করে দিলো। মোবাইল ঘড়িতে দেখে নিলো সময় ,রাত পৌনে একটা। ৫৩ % চার্জ আছে। চলে যাবে মনে হয় রাতটা। যাই চেঞ্জ করে আসি। এই ভেবে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াতেই মনে হলে দরজায় কেউ টোকা দিলো।
প্রতিবেশীর কোনো প্রয়োজন হয়েছে এই ভেবে দরজা খুলে বাইরের আবছা আলোয় রিনাকে দেখে অবাক হয়ে গেলো।
” আরে রীনা তুমি ? এতো রাতে ? কীভাবে এলে ? আদিল ভাই কোথায় ?”
” উফফ, এতো প্রশ্ন কেন তোমার শান ? আমি কি তোমার আদিলভাই ছাড়া কোথাও যেতে পারি না ?”
” নিশ্চয়ই পারো। কিন্তু এতো ঝড়জলের রাতে তুমি একা, তাই । “
” তারমানে আমি যে তোমার কাছে এসেছি সেটা তোমার পছন্দ হয় নি। “
” না, মানে , ব্যাঙ্গালোরের মতো জায়গায় এই দুর্যোগের রাতে একা কোরমঙ্গলা থেকে হোয়াইটফিল্ড চলে আসবে ,এ আমি কিছুতেই ভাবতে পারছি না।“
“ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি।” বলে দরজার হাতলে হাত রাখে রীনা।
শান্তনু বাধা দিয়ে বলে ,” না, এই অন্ধকারে তোমায় কোথাও যেতে হবে না। আমি আদিলভাইকে ফোন করে দিচ্ছি যে তুমি আমার এলাকায় আটকে গেছিলে তাই আমার বাড়িতে আছো। “
” সেসবের প্রয়োজন হবে না। বৃষ্টি থামলেই আমি চলে যাবো। “
“আবার অভিমান করছো রীনা। আমি তো তোমার ভালোর জন্যই বললাম। “
” আমার ভালোর জন্য তো তুমি অনেক কিছু করেছো শান। এবারে এই কাজটা না হয় নাইবা করলে। ” এই বলে মেঝেতেই বসে পড়লো রীনা।
” ওভাবে নিচে বসছো কেন রীনা ? জল খাবে? “
” না। “
“তোমার সঙ্গে আমার প্রথম কোথায় দেখা হয়েছিল শান, মনে আছে ?” জানলার দিকে তাকিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে রীনা।
” HSBC Bank ,বাগমানে টেক পার্ক । “
” ভাস্করের সঙ্গে কার লোনের জন্য তোমার কাছে গেছিলাম।
” সেই থেকে তোমার সাথে কথা শুরু হয় তারপর বন্ধুত্ব। তোমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড হয়ে পড়ি আমি। তুমি, আমি, আদিলভাই উইক এন্ডে কত আনন্দ করেছি। “
“ব্যাস ,ঐটুকুই শান, আর কোনো সম্পর্ক নেই আমাদের ?”
” তোমার যখন ডেঙ্গু হলো প্লেটকাউন্ট পঞ্চাশ হাজারেরও কম হয়ে গেছিলো। কলাম্বিয়া এশিয়াতে ভর্তি ছিলে। যমে মানুষে টানাটানি চলছে। আদিলের অমতে তোমার এটেন্ডেন্ট হিসেবে আমি ছিলাম। ব্যাঙ্ক থেকে ছ’দিন ছুটি নিয়েছিলাম বলে যা নয় তাই বলেছে। তুমি বাড়ি থেকে দূরে আছো , তোমার মা একা , ছেলের অসুস্থতার কথা জেনে কলকাতা থেকে একটা অজানা শহরে এসে নাস্তানাবুদ হয়ে যাবেন এই ভেবেই আমি তোমার সঙ্গে ছিলাম । “
.
” প্রত্যেকটা মুহূর্তই আমার মনে আছে রীনা। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পরেও তুমি বাড়ি এসে আমার যত্ন করে গ্যাছো। একদিন তোমার গালে কালশিটে দাগ দেখে জিজ্ঞেস করলাম ,কি হয়েছে ? তুমি কিছু বলতে পারলে না মাথা নিচু করেছিলে টপটপ করে চোখের জল পড়ছিলো । সেদিন আমি নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি ,দুহাতে তোমার মাথাটা বুকে চেপে ধরেছিলাম । “
” সেই মুহূর্তটা আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান মুহূর্ত ছিল। তোমার বুকে মাথা রেখে আমি সব ব্যাথা, কষ্ট ভুলে গেছিলাম। “
“তোমাকে রীনাম্যাম থেকে কখন রীনা বলে ডাকতে শুরু করেছিলাম মনে নেই । অকারণে তোমার দিকে কেউ আঙ্গুল তুলতে না পারে এই ভেবেই আমি কোরমঙ্গলা থেকে হোয়াইট ফিল্ডে শিফট করে গেছি। “
” তোমার এই বাড়িতেও তো আমি বেশ কয়েকবার এসেছি। ইস্যু না হবার জন্য বাড়িতে প্রতিদিনের অশান্তি ভোগ করে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়তাম তখন তোমার কাছে এসেই আমি একটু শান্তি পেতাম। এতো বড় পৃথিবীতে একমাত্র তোমার ওপর আমি নির্ভর করতাম এবং চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতাম। কিন্তু , কোভিড পরিস্থিতি শুরু হবার পর থেকে সব কেমন পাল্টে গেলো। তুমি আর আগের মতো টেক্সটে কথা বলো না। আমার কথার জবাব দাও না। ধীরে ধীরে কথাগুলো শুধুমাত্র গুডমর্নিং মেসেজে এসে ঠেকলো। প্রায় গত ছ-সাত মাস ধরে সেটাও কমে গেলো। ‘আমি কেমন আছি’, এই কথাটা কোনোদিনও তুমি জিজ্ঞেস করো নি। “
” তুমি ম্যারেড রীনা। তোমার ফ্যামিলি আছে। তারপরও কিভাবে তুমি অন্য কাউকে এতো গুরুত্ব দিতে পারো ? “
” ঠিক বলেছো শান ,আমার ফ্যামিলি আছে , তোমার চেয়ে সিনিয়র , আমার অন্য প্রায়োরিটি আছে তারপরেও কি করে আমি তোমায় এতো গুরুত্ব দিয়ে ফেলি আমি নিজেও জানি না। কখনো তোমাকে আমার পর বলে মনে হয় না ,তোমার সঙ্গে যতটুকু সময় কাটিয়েছি মনে হয়েছে নিজের মানুষের সঙ্গে আছি। তোমায় ভীষণ ভালোবাসি । কদিন ধরে খুব তোমার কথা মনে পড়ছিলো ,ইচ্ছে হচ্ছিলো একবার দেখে আসি তাই আজ ঝড়জল মাথায় করে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি । “
এক নিঃশ্বাসে ধরাগলায় কথা গুলো বলে আবার আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেলো রীনা।
কথাগুলো শুনে শানের ভেতরটা কেমন দুলে উঠলো। এগিয়ে এসে দুহাত দিয়ে রীনার মুখটা তুলে ধরতেই বিদ্যুতের আলোয় চোখের জলের রেখা চিকচিক করে উঠলো। আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না শান , শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে।আবেগের বাঁধ ভেঙে গেলো। বাইরে বৃষ্টির বেগ আরো বেড়ে গেলো। ঘরের ভেতর অন্ধকারে দুজনের মনপ্রাণ এক হয়ে গেলো। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে নেই।
ঘুম ভাঙলো রবীন্দ্রসংগীতের সুরে মোবাইল বাজার শব্দে। ভাস্করের ফোন। মোবাইল ঘড়িতে তখন ছটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট দেখাচ্ছে। রাতের নেশায় ঘুম জড়ানো কণ্ঠে শান্তনু জিজ্ঞেস করলো
“গুড মর্নিং ডুড। এতো সকালে ফোন ,অল ওয়েল ?”
” ব্রো , রীনা পাসড এওয়ে ইয়েস্টার্ডে। “
” হোয়াট ?” শান্তনুর নেশা আর ঘুম দুই উড়ে গেলো। কথা বলতে বলতে পাশে হাত রেখে দেখে কেউ নেই। আঙুলে একটা লম্বা চুল জড়িয়ে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কেউ নেই। গলার কাছে আঙ্গুল দিতেই লিপস্টিকের রং হাতে লাগলো।
ওদিকে ভাস্কর বলে চলেছে ,এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির জন্য ওভার ব্লিডিং শুরু হয় দুদিন থেকে ,বাড়িতে কেউ পাত্তা দেয় নি। মাদারহুডে যখন নিয়ে গেছে তখন আর কিছু করার ছিল না। “
ফোনটা বিছানায় ফেলে রেখে রী ই ই ই না বলে সদর দরজার দিকে দৌড়ে গেলো শান। এখনো অন্ধকার কাটে নি ভালো করে। অবিরাম ধারায় ঝরে চলেছে বৃষ্টি।
দরজা হাট করে খোলা , লবি থেকে আসা জোরালো হাওয়ায় ভারী দরজার পাল্লা দুলছে। । চৌকাঠের সামনে গিয়ে রীনা বলে চিৎকার করতে যাবে চোখ পড়লো মেঝেতে পড়ে থাকা টাটকা রক্তবিন্দুর ওপর।
ওদিকে রবীন্দ্রসংগীতের সুরে ফোন বেজে চলেছে ,
দূরে কোথাও দূরে ,দূরে……………………….।

By AjantaPrabahita

Every Story I create creats me.I am determined to be careful and happy in whatever situation I may find myself. I have learned to restore myself.I trust people with my heart, even if it will get broken I am proud of everything that I am and will become. ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *